শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:২২ অপরাহ্ন

৪০ বছর ধরে সুরের সৌরভ ছড়াচ্ছেন রাজকুমার

প্রতিনিধির নাম / ৮৮ বার
আপডেট : সোমবার, ১১ জুলাই, ২০২২

বুকে ঝুলানো একটি কাগজে লেখা ‘আমি অন্ধ রাজকুমার, বাঁশি বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি, আমাকে সাহায্য করুন’। তার এই সাহায্য প্রার্থনা আর বাঁশির সুরে মুগ্ধ মানুষেরা হাত বাড়িয়ে যা দেন, তা-ই জীবিকার অংশ রাজকুমারের। এভাবেই প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাঁশির সুরে আকৃষ্ট করা এই রাজকুমারকে নগরের বেশির ভাগ মানুষই চেনেন।

সম্প্রতি রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয় রংপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়। অন্ধ এই বংশীবাদক আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আর তার বাঁশির সুর শুনে থমকে দাঁড়ান অনেকেই। কেউ আবার রাজকুমারের কণ্ঠে গানও শুনেন। বাঁশির সুর আর গানে কারও মন ভরলে রাজকুমারের হাতে জোটে বকশিস।

সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে থাকেন রাজকুমার। বাকি দিনগুলো নগরের পাড়া-মহল্লার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়ান। দৃষ্টিহীন হলেও রাজকুমার রংপুরের পথঘাট সম্পর্কে সব ভালোই জানেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন তিনি নগরের বাস টার্মিনাল, কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ড, ধাপ মেডিকেল মোড়, লালকুঠি মোড়, সেন্ট্রাল রোড, লালবাগ, মুন্সিপাড়া, জুম্মাপাড়া, সুপার মার্কেট, কাচারীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে আনন্দিত করেন।

প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশি বাজিয়ে সংসার চালানো রাজকুমার থাকেন রংপুর সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাইম পীরজাবাদ (সাতগাড়া) এলাকার ডাক্তারপাড়ায়। স্ত্রী কনিকা রানী আর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়েই তার সংসার। গরু-ছাগল লালন-পালনের পাশাপাশি বাঁশের বাঁশির সুরে ভর করে দিন কাটছে তার।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বংশীবাদক রাজকুমার জানান, বাড়িতে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। তাই সকাল হলেই হাতে চার-পাঁচটা বাঁশি আর একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ি থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চড়ে শহরের দিকে এসে বিভিন্ন এলাকায় হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজান। সন্ধ্যা হলেই যা উপার্জন হয়, তাই নিয়ে ফিরে যান ঘরে।

আক্ষেপ করে ৬৫ বছর বয়সী রাজকুমার বলেন, কারও কাছে কিছু চাই না। আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে আছি এভাবেই বাকি জীবনটা চালিয়ে যেতে চাই। বাঁশি বাজিয়ে টুকটাক খবর আর নিজের নাস্তার টাকা হয়। প্রতিবন্ধী ভাতাও পাই। এ টাকায় তো আর সংসার চলে না। এ জন্য বাঁশি বাজিয়ে কিছু উপার্জনের পাশাপাশি বাড়িতে দুই-একটা গরু-ছাগল পালন করছি। এখন ভালোভাবে মৃ’ত্যু হলেই বাঁচি।

পরিবারের আর্থিক অভাব অটনের কারণে নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শেষ হয় তার প্রাইমারির গণ্ডি। আর কখনো বই-খাতা হাতে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল যাওয়া যায়নি রাজকুমারের। নিজে পড়া-লেখা করতে না পারলেও সংসারের হাল ধরে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার বড় ছেলে জয়ন্ত কুমার রায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এখন পেশকার হিসেবে কাজ করছেন। আর ছোট মেয়ে শিব্রা রাণী পড়ছে নবম শ্রেণিতে।

রাজকুমার বলেন, যুদ্ধের পর থেকে আমার চোখের সমস্যা শুরু হয়। বাবা ঠিক মতো ট্রিটমেন্ট করাতে পারেন নাই। এভাবেই আমার চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায়। আমার মা নেই। ছোটবেলা থেকেই আমি মা হারা। বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। পরে বাবাও মা’রা যান। এখন আমার বিধবা মা বেঁচে আছেন। আমি আমার দুই বাচ্চা আর বউকে সঙ্গে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি।

চার দশকের বেশি সময় ধরে বাঁশিতে সুর রপ্ত করা রাজকুমার মূলত রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়াকে বেশি গুরুত্ব দেন তার বাঁশের বাঁশিতে। এ ছাড়া পল্লীগীতি ও বিভিন্ন ছায়াছবির জনপ্রিয় গানের সুর তোলেন তিনি। বাঁশি ছাড়াও কখনো কখনো গানের আসরেও বসেন তিনি। তবে রমজান মাসে রাজকুমারের বাঁশির সুর রংপুর নগরবাসীকে ঈদ আনন্দের কথা বেশি স্মরণ করিয়ে দেয়।

Facebook Comments Box


এ জাতীয় আরো সংবাদ