শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৮ অপরাহ্ন

“মোবাইলের আর্থিক সেবায় চলছে জুয়ার লেনদেন”

রিপু / ৭৭ বার
আপডেট : সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক, নরসিংদী খবর ||

জুয়া খেলা দেশে সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবেও অনাচার হিসেবে স্বীকৃত। এরপরও মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের কল্যাণে অনলাইনে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে জুয়া খেলা। অল্প টাকায় বেশি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জুয়াড়ি চক্রের শতাধিক ওয়েবসাইট (বেটিং সাইট) বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আকৃষ্ট করছে সর্বনাশা খেলায়।

চক্রের সদস্যরা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছেন। যার পরিমাণ বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব জুয়ার লেনদেনে ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) অ্যাপ এবং কিছু ব্যাংকের অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাপ ও কার্ড, যা উদ্বেগজনক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ধরনের ১০টি বেটিং সাইট চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে, যেখানে জুয়ার অর্থ পরিশোধে এমএফএস ও ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারের তথ্য মিলেছে। সর্বনাশা জুয়ায় দেশের মোবাইল আর্থিক সেবার অ্যাপসগুলো শুধু ব্যবহৃতই হচ্ছে না, এমএফএসগুলোর মাধ্যমে জুয়ার প্রতিষ্ঠানকে ‘মার্চেন্ট’ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি (অনবোর্ড) করার ঘটনাও ঘটছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি ও সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ই বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়েই নানা কথাবার্তা হচ্ছে। তাই শুধু সতর্ক বা নির্দেশনা দিলেই হবে না, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো তা ঠিকমতো পরিপালন করছে কিনা সেটিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মনিটরিং করতে হবে। এজেন্টসহ কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।

যেভাবে চলছে অনলাইন জুয়া : এক্ষেত্রে ডলার কেনাবেচা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না। সব সময় বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে লেনদেন ও বেট নিতে পারবেন। এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাংকের কার্ড থেকেও লেনদেন করা যাবে। কয়েন জিতলেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারেন। কারও কাছে কয়েন বিক্রির জন্য বসে থাকতে হবে না। এজেন্ট থেকে আপনার বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ সরাসরি চলে যাবে। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে ‘সেভেন উইকেট ডটকম লাইভ’ নামে একটি সাইটে জুয়াড়ি চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিয়েছে জুয়ার নেশা। এ ধরনের শতাধিক বেটিং সাইট সক্রিয় রয়েছে দেশে, যেগুলো সাইটে ভার্চুয়ালি জুয়া খেলে অল্প টাকা বিনিয়োগে বেশি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অধীনস্থ সুপার এজেন্টদের মাধ্যমে স্থানীয় এজেন্ট বা মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে। ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা জামানত রাখা সাপেক্ষে এজেন্ট হওয়া যায়। এসব এজেন্ট জুয়ায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের ভার্চুয়াল চিপস বা কয়েন সরবরাহ করে। সেই চিপস বা কয়েন দিয়ে জুয়া খেলা হয়।

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব সাইটে জুয়া পরিচালনা করা হয় তার বেশিরভাগই দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন অনলাইন জুয়া খেলায় দেশে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ জুয়া খেলায় হারিয়েছেন, তার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা জানান- মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের কল্যাণে অফিস ও ঘরে বসেই অনেকে অনলাইন জুয়া খেলছেন। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচেও ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার এ ভয়াবহতা। সর্বনাশা এ নেশায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন।

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ১০০টির বেশি বেটিং ওয়েবসাইট ও অ্যাপস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সারাদেশে অবৈধ অনলাইন জুয়া কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট ও অ্যাপস বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল আলম বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার বেশকিছু সাইট সক্রিয় থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। দেশের বাইরে থেকে এসব সাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।’

সূত্রগুলো বলছে, যখনই জুয়া খেলার কোনো সাইট শনাক্ত হয় বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে তখনই তা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মাধ্যমে ব্লক বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের দুই শতাধিক সাইট বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সাইটগুলো নাম বদল করে বা মূল সাইটের কাছাকাছি নাম দিয়ে আবার ফিরে আসছে। আবার বন্ধ করা অনেক সাইট প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে তাদের খেলা চালাচ্ছে।

সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট বেটওইনার ডটকম পরিচালনাকারী তিনজন বাংলাদেশি এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে (সিআইডি)। সিআইডি জানায়, রাশিয়া থেকে পরিচালিত বেটওইনার সাইটে জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের টাকা ‘বাইন্যান্স’ নামে মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাপের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে কনভার্ট করত আটককৃত ব্যক্তিরা। পরবর্তীতে ওই অ্যাপসের মাধ্যমে এই টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যায়।

এমএফএস ও ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারে ১০ বেটিং সাইট চিহ্নিত : অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনলাইন বেটিং তথা অনলাইন জুয়া চক্রের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব সাইটে অংশগ্রহণের নিমিত্তে অর্থ লেনদেনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকিং অ্যাপ ও এমএফএস পরিশোধ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়, দেশে সক্রিয় বিভিন্ন অনলাইন জুয়া ওয়েবসাইটের মধ্যে অন্তত ১০টি বেটিং সাইটের লেনদেনে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যাংকিং অ্যাপ নেক্সাস-পে ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং অ্যাপ সেলফিন এবং এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, নগদ ও উপায়ের মাধ্যমে বেটিং সংক্রান্ত লেনদেন করা হচ্ছে। সাইটগুলো হলো মাস্তি ২৪৭ ডটকম, নাইন উইকেট ডটকম, সেভেন ইউকেট ডটকম লাইভ, ওয়ান এক্সবেট বিডি ডটকম, টাইগার এক্সচেঞ্জ ডটকম লাইভ, রিয়েল১৪২৩ ডটকম, জেটবাজ ডটকম এক্সওয়াইজেড, মেলবেট ডটকম ও লাইনবেট ডটকম।

দি পাবলিক গেমব্লেং অ্যাক্ট-১৯৮৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের জুয়া খেলা একটি অবৈধ কর্মকা- হিসেবে বিবেচিত। ফলে ব্যাংকিং অ্যাপ ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যানেল ব্যবহার করে এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রমে বেটিংয়ের জন্য অর্থ লেনদেন এবং এসব বেটিং প্রতিষ্ঠানকে বেটিং প্রতিষ্ঠানের নিজ নামে বা অন্য কোনো নামে মার্চেন্ট হিসেবে অনবোর্ড করার বিষয়টি আইনসিদ্ধ নয়। তাই এ বিষয়ে যথাযথভাবে মনিটর করার জন্য নির্দেশনা দিয়ে গত সপ্তাহে দেশের সব ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসার পরই এ ধরনের আর্থিক লেনদেন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সন্দেহজনক লেনদেনগুলো নিবিড় তদারকির আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে নগদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের হেড অব কমিউনকেশন্স জাহিদুল ইসলাম সজলের নামে পাঠানো বক্তব্যে বলা হয়, এ রকম কোনো লেনদেনের সঙ্গে নগদের কোনো রকম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। নগদের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও ‘নগদ’ পরিপূর্ণভাবে স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া মেনে চলে, যেখানে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ নেই। কোনো রকম সন্দেহের উদ্রেক করলে আইনগত প্রক্রিয়া মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়।

এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুধু অনলাইন জুয়া নয়, যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে আমরা নিয়মিত বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করে থাকি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ থেকে কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।’

 

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ   রিপু /নরসিংদী খবর

Facebook Comments Box


এ জাতীয় আরো সংবাদ