তাকে টাকা (ঘুষ) দিলে সবকিছুই সম্ভব। ঘুষ পেলেই তিনি ঠান্ডা। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলেও কোনো শাস্তি হবে না।
নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) নাসরীন আকতারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের। তবে ডিপিইওর শাস্তির মুখে পড়ার ভয়ে কেউ-ই নাম প্রকাশ করতে চান না। ডিপিইওর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ছাড়াও দুর্ব্যবহার, শিক্ষক হয়রানিসহ অনিয়ম-দুর্নীতির আরও বহু অভিযোগ তুলেছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড (জিপিএফ) থেকে ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে পেনশন পর্যন্ত সব ধরনের ফাইল ছাড় করতে ঘুষ দিতে হচ্ছে ডিপিইওকে। এ ছাড়া আর্থিকভাবে সুবিধা নিতে কথায় কথায় বহিস্কারসহ নানা হুমকি দিয়ে পুরো শিক্ষা অফিসকে জিম্মি করে ফেলেছেন তিনি। কোনো বিদ্যালয়ে পরিদর্শন করতে গেলে তার জন্য রাখতে হয় বিশেষ (ঘুষ) খাম।
বিভিন্ন উপজেলার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা অভিযোগ করেন, কোনো কোনো শিক্ষক বিনা অনুমতিতে প্রবাসে চলে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সবকিছু মিটমাটও করে দেন ওই কর্মকর্তা। চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলে সে ক্ষেত্রেও তিনি অক্ষমতার কারণ দেখিয়ে পেনশনের ব্যবস্থা করে দেন। আর এ সবকিছুই চলে ঘুষের বিনিময়ে।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর নরসিংদী সালিধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সে সময়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম। এই অনুষ্ঠানের খরচ মেটানোর কথা বলে ডিপিইও নাসরীন প্রতিটি উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ১০ হাজার করে টাকা নেন। এই টাকা তিনি নিজের কাছেই রাখেন। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এতকিছুর পরও আমরা কেউ-ই মুখ খুলতে পারছি না। তদন্ত হলেই সব বেরিয়ে আসবে।
অভিযোগ রয়েছে, মনোহরদী উপজেলার ২ নম্বর ধরাবান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফেরদাওস বেগমের অবসরজনিত ছুটি ও এককালীন নগদায়ন মঞ্জুরির আবেদন দাখিল করার পর ডিপিইওর সঙ্গে সমঝোতায় না আসায় অজুহাত বের করে সেই প্রক্রিয়া স্থগিত করে রাখা হয়েছে।
রায়পুরার তুলাতুলি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়েশা আক্তার গত বছরের ২৫ আগস্ট চাকরিতে অক্ষমতার কারণ দেখিয়ে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী স্বামীর কাছে চলে যান। আয়েশা আক্তারের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন। আয়েশা আক্তার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে অক্ষমতাজনিত সনদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এতে ওই বিদ্যালয়সহ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে নরসিংদীর সিভিল সার্জন নূরুল ইসলাম বলেন, কোনো আবেদন পাওয়ার পর একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে আয়েশা আক্তার নামে কারও অক্ষমতাজনিত সনদ দেওয়া হয়নি। তবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকতা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে একজন সুস্থ শিক্ষককে অসুস্থ বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাঠাতে সহযোগিতা করেছেন। অথচ মেথিকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা পারভীন আক্তার অক্ষম হলেও আবেদনের দীর্ঘ চার মাস পর তিনি অক্ষমতার সনদ পান।
মেথিকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা বেগম বলেন, পারভীন আক্তার চোখে দেখেন না এবং শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ।
রায়পুরার জিরাহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার পূর্ব অনুমতি ছাড়া ১৬ মাস যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে এসে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ‘খুশি’ করে কাজে যোগদানের অনুমতি পান। তিনি ২০২০ সালের ১৭ মার্চ ছুটি না নিয়ে প্রবাসে গিয়েছিলেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, চিকিৎসা করানোর জন্য তিনি প্রবাসে গিয়েছিলেন। যদিও নিয়ম অনুযায়ী বিনা অনুমতিতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লঘুদণ্ড (তিরস্কার) দিয়ে শিরিন আক্তারকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেন ডিপিইও।
রায়পুরা উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিরাহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার পেনশন নিয়ে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে যেতে ডিপিইওর সঙ্গে সমঝোতায় এসেছেন।
তারা আরও অভিযোগ করেন, টাকা না পেলে কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) আটকে রাখা, বদলির ফাইল অগ্রায়ন না করাসহ নানা অজুহাতে টাকা দাবি করেন ডিপিইও। প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি ও নানা হয়রানি করতেও ছাড়েন না তিনি। দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার কারণে নরসিংদীর প্রাথমিক শিক্ষায় মহাসংকট তৈরি হয়েছে।
তবে জেলা প্রথামিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসরীন আকতার কোনো দুর্নীতি করেন না বলে দাবি করেছেন। অনুমতি না নিয়ে জিরাহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তারের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।