নিউজ ডেস্ক,নরসিংদী জার্নাল।। এক সারিতে ধনী-গরিব সবাই মক্কা-মদিনার আদলে ইফতার করে।
বিকেল সাড়ে ৫টা। মসজিদের ভেতর লম্বা সারি। মুখোমুখি লম্বা কয়েকটি সারিতে বসে আছেন নানান পেশার মানুষ। এক কাতারে ব্যবসায়ী আছেন, আছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, ভিক্ষুকও। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই ধনী-গরিবের। এমনভাবে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করেন এখানে।
রমজানের সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের প্রতিদিনকার চিত্র এটি। এখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। অনেকে ইফতার কিনতে না পেরে চলে আসেন এখানে। আবার অনেক আসেন বেশি মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করলে সওয়াব বেশি পাওয়া যাবে সেই আশায়। গত ১৪ বছর ধরে চলছে এ আয়োজন।
গত বুধবার বিকেলে মসজিদে গিয়ে দেখা যায় মসজিদের বারান্দায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে রকমারি ইফতারি। এসব তৈরির কাজ শুরু হয় সকাল ৮টায়। ১০ জন বাবুর্চি এই ইফতারি তৈরি করেন। এরপর আসর নামাজের পর থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা প্লেট প্লেটে ইফতার সামগ্রী রাখা শুরু করেন। ইফতার সাজানো হয় বড় ধরনের ডিশেও। আসরের নামাজের পর থেকেই লাইন ধরে বসে যান ইফতার করতে আসা মানুষজন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন বাড়তে থাকে।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটা পেরোতেই মসজিদে ইফতারের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো ইফতারের প্লেট দিতে শুরু করেন সবার হাতে হাতে। প্লেটে থাকে খেজুর, ছোলা, মুড়ির প্যাকেট, পিঁয়াজু, বেগুনি, সমুচা, আলুর চপসহ আরও অনেক কিছু। সবার সামনে পৌঁছে দেওয়া হয় সরবতের গ্লাসও। এছাড়া ছয়জন গোল হয়ে বসে গেলে তাদের দেওয়া হয় ইফতার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা ডিশ। ইফতারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আসা সকলের হাতেই ইফতারের প্লেট পৌঁছে দেওয়া হয়। আর পাশের মঞ্চে চলে আলোচনা। ইফতারের পাঁচ মিনিট আগে মোনাজাতে অংশ নেন সব মুসল্লি। আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ইফতার।
আর কয়েক হাজার মানুষকে ইফতার করানোর কাজটির নেপথ্যে রয়েছেন মসজিদের খতিব হযরত ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরী আল মাদানী। তিনি ২০০১ সালে ছোট পরিসরে প্রথমে এই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন। আর বড় পরিসরে গণইফতারের আয়োজন চলছে ২০০৮ সাল থেকে। তবে করোনার কারণে মাঝে দুই বছর বন্ধ ছিল এই আয়োজন।
হাসান মুরাদ আরও বলেন, এখানে ইফতার আয়োজনে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একে অপরের পাশে বসে আনন্দের সঙ্গে ইফতার করেন। কারও জন্য আলাদা কোনো মেন্যু নেই। সবাই এক কাতারে বসে একসঙ্গে ইফতার করেন। আর এই আয়োজনে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেকে।
তিনি জানান, শরবতসহ নয় প্রকারের জিনিস দিয়ে ইফতার করানো হয়। মাঝেমধ্যে বিরিয়ানিও দেওয়া হয়ে থাকে। অন্য ধর্মের অনেকেও এখান থেকে ইফতার নিয়ে যান। তারা চাইলে আমার দেই। কারণ ইসলাম তো সাম্যের ধর্ম।
কয়েক বছর ধরে এ আয়োজনে সহযোগিতা করে আসছেন শহিদুল আলম। তিনি শরবত তৈরির কাজ করেন। তিনি নরসিংদী জার্নালকে জানান, আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে রোজাদারদের ইফতারে শরবত দেওয়া হয়। সেটা আমি তৈরি করি। দুই-তিন হাজার মানুষের শরবত তৈরি করা হয়। এই কাজে অংশ নিতে পেরে ভালো লাগে।
মাঈনউদ্দিন নামের আরেক স্বেচ্ছাসেবক নরসিংদী জার্নালকে জানান , ৮ বছর ধরে এখানে কাজ করি। প্লেট ধোওয়ার কাজ করি আর শরবত বিতরণ করি। খুবই ভালো লাগে।
মুহাম্মদ সৈয়দুল হক নামে একজন নরসিংদী জার্নালকে জানান, কয়েক বছর ধরেই রোজাদারদের ইফতারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। কাজটি করে আনন্দ পাই। মসজিদের খাদেমসহ ২০ জন এখানে কাজ করি।
ইফতার করতে এসেছিলেন দিনমজুর মো. মালেক মিয়া। তিনি বলেন, এখানে সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করে। কে কী করে তা দেখা হয় না। সবার জন্য একই রকমের ইফতারি। ধনী গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই।
তার পাশেই বসা ছিলেন চট্টগ্রামের জামেয়া আহম্মদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসার ছাত্র আতাউল মোস্তফা। তিনি নরসিংদী জার্নালকে জানান, আন্দরকিল্লাতে একটা কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গেছে। তারপর মসজিদটিতে একসঙ্গে অনেক মানুষ ইফতার করে শুনে এলাম। আজ নিজেও ইফতার করলাম। আসলে সবার সঙ্গে বসে একসঙ্গে ইফতার করে অনেক ভালো লাগে। একসঙ্গে বসে ইফতারের মজাই আলাদা।
মসজিদে ইফতারে এসেছিলেন চাকরিজীবী আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি নরসিংদী জার্নাল জানান, প্রতিবছর একবার এই মসজিদে ইফতার করি। সবাই একসঙ্গে বসে একই ইফতারি করতে অনেক শান্তি লাগে।
নাহিদুল ইসলাম নামে আরেকজন এসেছিলেন হাটহাজারী থেকে। আন্দরকিল্লায় কাজ শেষ করতে করতে ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় চলে আসেন মসজিদে।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাসরিফ/ নরসিংদী জার্নাল