জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, নরসিংদী জার্নাল।। ‘আমার বাপের মতো আর কেউ পৃথিবীতে না আসুক’
‘চুরি করি না, ভিক্ষা চাই না, মানুষের ক্ষতি করি না। নিজের হাত পা আছে বলেই কাজকর্ম করে সংসার চালাই। চানাচুর-ঝালমুড়ি বিক্রিই আমার একমাত্র ভরসা।’ —কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল কিশোর লিলু মিয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে বৃহস্পতিবার বিকালে লিলু মিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়। লিলুর মজাদার চানাচুর-ঝালমুড়ি খাওয়ার অপেক্ষায় থাকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেই মজাদার ঝালমুড়ির বিক্রির আড়ালে লুকিয়ে আছে তার দুঃখভরা জীবনযুদ্ধের গল্প।
লিলুর বাবা থেকেও নেই। মায়ের অসুস্থতা থাকে সারা বছরই। এ কারণে লিলুর বাবা আরেক নারীকে বিয়ে করেছেন। এখন অসুস্থ মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকে লিলু। তাকেই চালাতে হয় তিনজনের এই সংসার।
জীবন-জীবিকার তাগিদে ১০ বছর বয়স থেকে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে মুখরোচক চানাচুর-ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করে লিলু মিয়া। এখন তার বয়স ১৩। রাজধানীর শাহবাগ, টিএসসি, শহীদ মিনার, অফিস আদালতসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তার এই ক্ষুদ্র ব্যবসা চলে।
যে বয়সে পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা আর মা-বাবার আদরে বড় হয় অন্যরা, সেই শিশু বয়সে রোদে-বৃষ্টিতে চানাচুর-ঝালমুড়ি বিক্রি করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে লিলু।
প্রায় ৭০০ টাকার পুঁজি খাটিয়ে লিলুর এই ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু হয়। এর মাধ্যমে যা আয় হয় তা দিয়ে অসুস্থ মায়ের খাবার, ওষুধের খরচ, ছোট ভাইকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।
লিলু মিয়া জানায়, তাদের মূল বাড়ি বরিশাল। জন্মের পর থেকে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার ফুটপাতে বড় হয়েছে। পাঁচ বছর বয়স থেকে লিলু দেখে আসছে মাকে মারধর করছে বাবা। একসময় মা অসুস্থ হয়ে পরেন। বাবা সংসার ছেড়ে চলে যান। বিয়ে করেন আরেক নারীকে।
দুই সন্তান নিয়ে মহাবিপদে পড়েন লিলুর মা। দিনকে দিন না খেয়ে ফুটপাতে থাকতে হয়েছে তাদের। মায়েরও শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। তখন থেকে লিলু রেলস্টেশনে মানুষের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতো। বিনিময়ে দিন শেষে কিছু টাকা পেত।
বয়স বাড়ার সঙ্গে চিন্তাও বাড়ে ছোট্ট লিলুর। ‘একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তো পড়াশোনা করতে পারছি না, আমার ভাইকে পড়াশোনা করাতে হবে। তাকে অনেক বড় করতে হবে। এসব চিন্তা থেকে চানাচুর-ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করলাম।
ছোট এক রুমের বাসাও নিলাম মোহাম্মদপুর এলাকায়। আমার মা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এজন্য দিনরাত কাজে থাকি। মাসে মাসে ডাক্তার দেখাই, ওষুধ কিনি। ভাইকে পড়াশোনা করাই।’ বলে লিলু।
শিশু বয়সে জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া লিলু বাস্তবতাও ভালো বুঝে এখন। ‘এই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়, সবাই স্বার্থপর। আমার বাপের মতো আর কোনো বাপ পৃথিবীতে যেন না আসে।‘ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তার।
দুঃখ ভারাক্রান্ত লিলুর এমন প্রতিক্রিয়ায় আশপাশের পরিবেশ যেন ভারি হয়ে ওঠে। শেষে লিলুর সঙ্গে মিলে তারই মাখানো ঝালমুড়ি খেয়ে বিদায় নেন এই প্রতিবেদক।
এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ন বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাসরিফ/নরসিংদী জার্নাল