সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি,নরসিংদী জার্নাল।।আপ্লুত পর্যটক গাছের ডালে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে বাঘ
চিত্রকর ফরিদি নোমান। শতবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেও কখনো বাঘের দেখা পাননি। তবে এবার কাঙিক্ষত বাঘের দেখা পেয়েছেন। সুন্দরবনে বাইন গাছের ডালে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা একটি বাঘ দেখতে পেয়ে ঘণ্টাখানেক আশপাশ ঘুরেছেন আর ছবি তুলেছেন। বাঘের দেখা পাওয়ার সেই সময়ের অনুভূতি নরসিংদী জার্নাল কাছে ব্যক্ত করেছেন এই চিত্রকর।
ফরিদি নোমান গোপালগঞ্জের সুকতাইল গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা প্রফেসর মনিরুজ্জামান ফরিদি। সুকতাইল গ্রামে বাড়ি হলেও বাবা বাড়ি করেছেন ফরিদপুরে। ফরিদি নোমান থাকেন রাজধানী ঢাকায়। আগে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন রাজধানীতে চিত্রকর হিসেবে কাজ করেন।
সুন্দরবন ভ্রমণের শুরুর কথা জানিয়ে ফরিদি নোমান বলেন, ২০০৪-০৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রোগ্রাম থেকেই সুন্দরবনে যাওয়া শুরু। এরপর থেকেই সুন্দরবনের পেছনে ঘোরাঘুরি। বাঘ মামা ছিলেন কামাল ভাই, তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন। পাশাপাশি আরও অনেকেই ছিলেন। করোনার আগে প্রতি বছর ৬-৭ বার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে একশ বার সুন্দরবনে গিয়েছি। আমি মূলত ভিডিও করার জন্য যেতাম। এবার পাখির ফটোগ্রাফির জন্য কয়েকজন গিয়েছিলাম। পাখির নিয়ে কাজ করি। ভেবেছিলাম পাখির ফটোগ্রাফি করব।
তিনি বলেন, ৩১ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় বাঘের দেখা পাই আমরা। তবে দুটি কারণে সঠিক লোকেশন জানাচ্ছি না। কারণ বাঘটি ম্যাচিউরড না। অল্প বয়সী বাঘ মনে হয়েছে। সঠিক লোকেশন প্রচার হলে অন্যরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে বাঘকে উত্ত্যক্ত করতে। আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে অনেক চোরা শিকারী থাকে, যারা সুন্দরবনের বাঘ শিকার করার ধান্দায় থাকে। সঠিক লোকেশন প্রচার হলে বাঘটি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। সে কারণে বন বিভাগও অনুরোধ জানিয়েছে সঠিক জায়গাটি প্রচার না করতে। বাঘটির দেখা পেয়েছি পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়।
বাঘের দেখা পাওয়ার বিষয়ে ফরিদি নোমান বলেন, ওইদিন সকালের দিকে সুন্দরবনের জামতলা এলাকায় পাখি নিয়ে কাজ করেছি। একটি অজগরের বাসাও দেখে এসেছি। প্রচণ্ড গরমে আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম লঞ্চে কটকা অফিস এলাকায় ঘোরাঘুরি করব। তখন খুব ঢেউ হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ১০-১৫ কিলোমিটার ভাটায় চলে যাই। দুইজন সিনিয়র সদস্য অনীহা প্রকাশ করল, আর দরকার নেই। হাঁটাহাটির পক্ষে যাচ্ছিলেন না। এছাড়া লঞ্চে তেলের সংকট ছিল। এরপর নৌকায় নামলাম। একটা খালে গেলাম পাখি দেখলাম। আশায় করিনি আমরা বাঘ দেখতে পাব। তবে বাঘ দেখার আশা তো ছিলই। এটি ছিল আমাদের ভ্রমণের তৃতীয় দিন। বাঘের দেখা না পেয়ে হতাশ হলাম।
ভেবেছিলাম, এবারও হচ্ছে না। তখন আরেকটি খালে গেলাম সেখানে পানি কম ছিল। নৌকা ঢুকানের মতো অবস্থা না সেখানে। হঠাৎই বাইন গাছের ডালের ওপর হলুদ কিছু একটা দেখতে পাই। প্রথমে বিশ্বাসই করিনি ওটা বাঘ ছিল।বাঘ দেখার অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। সাধারণত বাঘকে গাছে দেখা দুর্লভ। শ্বাসমূলের মধ্যে, পানির মধ্যে বা জঙ্গলের মধ্যে বাঘ দেখা যায়। এই দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা। আমাদের নৌকা প্রায় গাছের নিচ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ আমরা চমকে গেলাম। এটা বাঘ, তা চিন্তা করতেও সময় লেগেছে। জ্ঞান কাজ করছিল না। গাইড ছিল চিৎকার করে উঠল বাঘ বাঘ। সবাই বনের ভেতরে এখানে সেখানে নজর দিচ্ছিল। কিন্তু বাঘটি বসে ছিল গাছের ডালে। গাছের ডালে বাঘ শুয়ে আছে সেটা বাকি সদস্যরা বুঝতেও কিছুটা সময় নিয়েছে। ৫-১০ মিনিট আমাদের কারও জ্ঞানে কাজ করেনি। অনেকটা বেহুঁশ অবস্থায় ছবি তুলেছি। আমাদের নৌকার খুব কাছেই ছিল।
আমাদের দেখে নড়েচড়ে বসল বাঘটি। লাফ দিয়ে নৌকায় এসে পড়তে পারে ভেবে দ্রুত নৌকা সরিয়ে নিলাম। সরিয়ে দেখি আবার ডালে বসে পড়ছে। গাছের আরেকটা ডালকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছে। মায়াবী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা ৫০ বার নৌকা দিয়ে আশপাশে ঘুরেছি ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি প্রায় ঘণ্টা খানেক। এরপর ফিরে আসি।
বন বিভাগ থেকে চারদিনের অনুমতিপত্র নিয়ে ফরিদি নোমানের ৯ জনের পর্যটক দলটি বাগেরহাট জেলার মংলা এলাকা দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। দলের সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ নয়জন। একজন ছিলেন বনবিভাগের গাইড। নয়জনের সঙ্গে একজন এই প্রথমবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। আর প্রথম বারই দেখা পেয়েছেন সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।
ফরিদি নোমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে থেকে লেখাপড়া শেষ করেন ১৯৯০ সালে। কাজ করেছেন দৈনিক ইনকিলাব, নয়াদিগন্তসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সর্বশেষ দিগন্ত টিভির নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বর্তমানে চিত্রকর হিসেবে কাজ ঢাকায় করছেন।
খুলনা বিভাগের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে নরসিংদী জার্নাল বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবন ভ্রমণের সময় বেশ কয়েকটি বাঘের দেখা পেয়েছেন পর্যটকরা। প্রথমে একটা, তারপর চারটা ও গত পরশু একটার দেখা পেয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন পর্যটক দল। এছাড়া বন বিভাগের কর্মীরাও বাঘের দেখা পাচ্ছেন। বাঘ দেখা যাচ্ছে পূর্ব বন বিভাগ এলাকায়। খুলনা অঞ্চলের পশ্চিম বন বিভাগে দেখা যায়নি এখনো।
সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুন্দরবনে বাঘ বাড়ছে না কমছে সেটা জরিপে শেষ হলেই বলা যাবে। বছরের শেষ নাগাদ জরিপ শেষ হবে, তখন বলা যাবে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ ছিল।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাসরিফ/ নরসিংদী জার্নাল